মুনির হাসান। নিজের নামেই বিখ্যাত এক মানুষ। বুয়েটে পড়ালেখা করেছেন। কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে। আর ৯৫-৯৮ সাল পর্যন্ত ভোরের কাগজ ও ৯৮ সাল হতে প্রথম আলোর বিজ্ঞান ও গণিত পাতা সম্পাদনা করছেন। গণিত, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করছেন। এবং কাজ করছেন দৈনিক প্রথম আলোর ইযুথ প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর হিসাবে। ২০১১ সাল হতে চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব ফেসবুক গ্রুপের সূচনা হয় তার হাত ধরেই। এই গ্রুপটিতে এখন সংযুক্ত আছেন ৭৮ হাজারেরও বেশি উদ্যোক্তা ও হবু উদ্যোক্তা।
এই অসাধারণ মানুষটির ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট, মুনির হাসান ডট কম যারা নিয়মিত ফলো করেন, তারা ইতোমধ্যে তার [বাপ ও ছেলের] মুনির অ্যান্ড মুনির শোও শুনেছেন। ইতোমধ্যে বিকাশ-এর সিইও কামাল কাদিরের রেকর্ডেড ইন্টারভিউসহ প্রচারিত হয়েছে, আরো কয়েকটি পর্বও! আর এই শো’র চমৎকার অবতরনিকা লিখেছেন মুনির হাসান নিজেই, তার ওয়েবসাইটে। সেখানে লিখেছেন, “এই আইডিয়াটা আমার নয়। ফারদীম মুনির রুবাইয়ের।” মানে এই শো’র আইডিয়া তার পুত্রের। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করেও, একটি কন্টেন্ট কত তুখোড় ও দুর্দান্ত হতে পারে, তার নমুনা এই শোটি। আগ্রহীরা ইচ্ছা করলে, ঢুঁ মেরে আসতে পারেন মুনির হাসান ডট কম থেকে।
…গ্রোথ হ্যাকিং
হলো এমন একটা
মার্কেটিং পদ্ধতি, যার
সঠিক ব্যবহার শুধু
নবীন উদ্যোক্তা নন, প্রতিষ্ঠিত
উদ্যোক্তাদেরও গ্রোথ
বাড়াতে সহায়তা করে…
খুব সম্প্রতি আদর্শ থেকে মুনির হাসানের নতুন বই গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং বেরিয়েছে। এ সম্পর্কিত বাংলাভাষায় এটিই প্রথম বই। মার্কেটিংয়ের ব্যাপারটিকে নিজের পণ্যের বা সেবার সঙ্গে যুক্ত করে কোনো প্রতিষ্ঠান কীভাবে তার গ্রোথ বাড়াতে পারে, তারই ব্যবহারিক কর্ম পরিধি নিয়ে উক্ত পুস্তক। এ সম্পর্কে, বইটির ১ম ফ্ল্যাপে বলা হচ্ছে,
“গ্রোথ হ্যাকিং হলো এমন একটা মার্কেটিং পদ্ধতি, যার সঠিক ব্যবহার শুধু নবীন উদ্যোক্তা নন, প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদেরও গ্রোথ বাড়াতে সহায়তা করে। কোনো কোনো সময় এটি একেবারে নিঃখরচায়ও করা যায়।…
এ বইটি সে রকম মার্কেটিং পদ্ধতির একটা বই। দেশ-বিদেশের নানান উদাহারণ দিয়ে এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কীভাবে একজন উদ্যোক্তা তার উদ্যোগের সম্পসারণে এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবেন।”
ফ্ল্যাপের আংশিক এই বয়ানটুকোই আগ্রহী পাঠককে একটা ধারণা দিতে সক্ষম, কেন এই বই? বা কি নিয়ে এই বই? তারপরেও, আরো বিস্তারিত জানার জন্য, বইটা আপনাকে কিনতে হবে। পড়তে হবে।
২.
ভূমিকা ও পরিশিষ্ট ছাড়াই বইটাতে গদ্য আছে ১৬টি। প্রতিটি গদ্যই আয়তনে ছোট। কিন্তু যথার্থ তথ্যসহ যথেষ্ট প্রতিটি গদ্যই। ঝরঝরে ভাষা। নির্মেদ খুব। প্রয়োজনীয় উদাহারণ, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রতিটি বিষয়কে বুঝতে সহায়তা করে। গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিংকে বুঝাতে লেখক টুলস হিসাবে ব্যবহার করেছেন, ফেসবুক, উবার, হটমেইল, জিমেইল, এয়ারবিএনবি, ইনস্টাগ্রাম, রেডিট, উইকিপিডিয়া-সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানকে বা তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিকে।
সর্বমোট ৭২ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম মাত্র ১৫০ টাকা। প্রকাশক আদর্শ। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। কিনতে পাবেন রকমারিতেও।
লেখকের ফেসবুকে তার এক ফলোয়ার [আরিফুজ্জামান আরিফ] ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ লিখেছেন, “গতকাল দুপুর ২.২০ এ বইটা হাতে পেয়ছি। আজকে ঘড়ির কাটা ২.২০-এ যাওয়ার আগেই পড়া শেষ 🙂 । মার্কেটিং-এর আগের দিন আর নাই। গ্রোথ হ্যাকিং হলো একটু ভিন্নধারার মার্কেটিং। ইঞ্জিনিয়াররাও যে দারুণ মার্কেটিং করতে পারে সেটা এই বইয়ে এয়ারবিএনবি এর শুরুর দিকের মার্কেটিং পদ্ধতিটি পড়লে বুঝতে পারবেন। হটমেল গল্পটা তো আরো হট। ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় মুনির হাসান স্যারকে এ রকম একটা চমৎকার বই লেখার জন্য।
উদ্যোক্তা হতে চান বা আপনি উদ্যোক্তা, মার্কেটার বা অন্য যে কেউ, বইটি পড়তে পারেন। মনে রাখবেন, গ্রোথ হ্যাকিং যে শুধু ব্যবসা, মার্কেটিং এসবে সাহায্য করে তা কিন্তু না। এই বই পড়তে পড়তে খুঁজে পেতে পারেন বউয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো করার হ্যাকিং ট্যাকনিক :p”
৩.
বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিলে বইটা সম্পর্কে আরো বেশি ফর্সা করা যাবে আপনার কাছে। আসুন নির্বাচিত কিছু উদ্ধৃতি পড়ি :
- অন্যদিকে এখন ট্র্যাডিশনাল আউটবাউন্ড মার্কেটিং দিন দিন বাজার হারাচ্ছে। ইনবাউন্ড মার্কেটিংয়ের ব্যাপারটা অনেক বেশি মুখ্য হয়ে উঠছে আজকাল। ইনবাউন্ড মানে হলো গ্রাহককে নিজের কাছে টেনে আনা। গ্রাহকের সঙ্গে একটা বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করা। যাতে তিনি মনের আনন্দে আমার মার্কেটিংয়ের কাজটা করে দেন। [শুরুর শুরু। পৃষ্ঠা ১৫]
- উবার আর মিনিপ্যাকের উদাহরণ থেকে বোঝা যায় এমন কিছু যদি করা যায়, যা কিনা একটা বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করে, তাহলে সেটার বিক্রি, বিপণন নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না। গ্রাহকই তখন হয়ে যান বিজ্ঞাপক। [কাজের জিনিস বানান। পৃষ্ঠা ২৫]
- এবারনোটের কথা ধরা যাক। এই স্টার্টআপটি প্রডাক্টিবিটি আর অর্গানাইজেশন টুলস বানিয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরুর কয়েক বছর মার্কেটিংয়ে কোনো টাকাই খরচ করেনি। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ফিল লিবেনের বক্তব্য সোজা, যারা সেরা পণ্য বানানোর বদলে অন্য কিছু চিন্তা করে, তারা সেরা পণ্য বানাতেই পারে না। [কাজের জিনিস কেমনে বানাই। পৃষ্ঠা: ৩৩]
- ভাইরাল হলো দ্রুত, মানুষে মানুষে সংক্রামিত ওয়ার্ড অব মাউথের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এটি কিন্তু চাইলেই ঘটে না। তবে কিন্তু একটি দুর্ঘটনাও নয়। [ভাইরালিটি ইজ এ সায়েন্স, নট এ লাক। পৃষ্ঠা: ৪৬]
- গ্রোথ হ্যাকিং হলো আরওআইয়ের সর্বোচ্চ বাড়ানো। মানে হলো নিজেদের শ্রম ও টাকা এমন জায়গায় খরচ করা, যেখান থেকে ফলাফল পাওয়া যাবে। এমন ফিচার যোগ করেন, যাতে এখনকার গ্রাহকদের থেকে আপনি বেশি কিছু পান, সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য গ্রাহকদের সক্রিয় গ্রাহকে পরিণত করেন। গ্রাহককে আপনার সেবা বা পণ্য সম্পর্কে শিক্ষিত বানান, যেমনটা ফেসবুক বা আমাজন করে। এতে তাদের আরও ব্যাক্তিগত বিষয় বের করে আনেন যা তাদের আপনার সঙ্গে আরও বেশি এনগেজ করবে। [স্কেলিং রিটেনশন অ্যান্ড অপটিমাইজেশন। পৃষ্ঠা: ৬৬]
৪.
বোধকরি গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং গ্রন্থের বা লেখকের আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র মার্কেটিংয়ের টেকনিক শেখানো নয়। এই গ্রন্থটা আসলে মুনির হাসানেরই একটা জেরক্স কপি, যা মূলত পাঠককে বা হবু উদ্যোক্তা বা একজন স্বাপ্নিক মানুষকে অনুপ্রেরণার বিশাল উন্মুক্ত আকাশের দিকে ঠেলে দেবে। সো প্রিয় পাঠক, হ্যাপি রিডিং– ‘গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং’ । সঙ্গে সঙ্গে, এই বইটির হাত ধরে, নিজের আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে খ্যাপা ও স্বপ্নবান মানুষ মুনির হাসানের পৃথিবীতে স্বাগতম আপনাকে।